
নাড়াজোল 16 ই সেপ্টেম্বর:
নারী শক্তির আরাধনায় নারীরাই ব্রাত্য ৬০০ বছরের বেশি সময় ধরে এভাবেই চলে আসছে দাসপুরে নাড়াজোল রাজবাড়ির দুর্গা পুজো,এবছর রাজবাড়ির পুজো ৬১২ তম বছরে পদার্পন করবে।রাজবাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী থেকে বিভিন্ন মনীষীর।এই রাজবাড়ি পরিদর্শন এসেছিলেন নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু থেকে মহাত্মা গান্ধী।

মায়ের পুজোতে মায়েরাই ব্রাত্য এমনটাই চলে আসছে ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুরের নাড়াজোল রাজবাড়ির দুর্গাপুজো।এটাই রাজবাড়ির প্রথা আর সেই প্রথা আজও অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন রাজ পরিবারের মহিলারা।রাজ পরিবার সূত্রে জানা যায় বর্ধমান রাজার নায়েব ছিলেন উদয়নারায়ন ঘোষ।তিনি মেদিনীপুর জেলায় শিকার করতে এসেছিলেন।দাসপুরের নাড়াজোল জঙ্গলে শিকার করে ফেরার পথে হঠাৎই দেখেন একটি সারস পাখি বককে তাড়া করছে।এই দৃশ্য দেখে চমকে গিয়েছিলেন নায়েব মশাই।সেই সারস পাখি শিকার করতে গিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলে এখানেই রাত্রিযাপন করেন।সেই রাতেই তিনি স্বপ্নাদেশ পান মা দুর্গার পুজো করার জন্য।ওই জঙ্গলেই একটি বাড়িতে রয়েছে মা দুর্গার অষ্টধাতুর মূর্তি।মায়ের নির্দেশে সেই মূর্তি জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।নাড়াজোল এলাকার জঙ্গল সাফাই করে তৈরি করেন বাড়ি।

এই বাড়িতেই অষ্টধাতুর দুর্গা মূর্তি পূজা শুরু করেন বাংলার ৮২০ বঙ্গাব্দে।উদয়নারায়ণ ঘোষ দুর্গা পুজোর সূচনা করেছিলেন,পরবর্তীকালে উদয়নারায়ণ ঘোষ নাড়াজোল রাজ বাড়ির প্রতিষ্ঠা করেন।দুর্গাপুজোর যাবতীয় বিধি নিষেধ তিনি চালু করেন।তখনকার সময়ে চার পুরুষ ‘ঘোষ’ পদবি নিয়েছিলেন।তারপর নেন ‘রায়’ পদবি।১০৩০ বঙ্গাব্দে মুঘল আমলে আকবরের নাজিম সাহেব এই রাজবাড়িতে এসেছিলেন তাকে খাওয়া দাওয়া ও উপঢৌকন দেওয়ার জন্য ‘খান’ পদবি দিয়েছিলেন।তখন থেকেই এই ‘খান’ পদবি ব্যবহার করে আসছেন।মেদিনীপুর জমিদারির সদর দপ্তর কর্ণগড়ের সাথে নাড়াজোল রাজবাড়ীর শাসকদের ঘনিষ্ঠতা ছিল।যদিও আজ নাড়াজোল রাজবাড়ি ধ্বংসের পথে,রাজ বাড়ির বহু ভবন ভগ্নপ্রায়।আগাছায় ঢাকা পড়ছে রাজবাড়ির সৌন্দর্য্য ও কারুকার্যের নিদর্শন।কিন্তু প্রথা মেনে আজও রাজবাড়ীতে অষ্টধাতুর দুর্গা মূর্তি পূজিত হন।

রাজবাড়ীতে বৈষ্ণব মতে পূজিত হন মা দুর্গা তাই নেই বলি প্রথা।সেই প্রথা মেনে আজও রাজবাড়ির মহিলারা মায়ের অঞ্জলি দিতে পারেন না।নিতে পারবেন না প্রসাদ ও বেলপাতাও।সমস্ত জোগাড় আয়োজন করে দিলেও মায়ের প্রসাদ ও ভোগ রান্না করেন পুরোহিত।তবে মায়ের বিদায় বেলায় সিঁদুর খেলায় অংশ নেয় রাজ পরিবারের মহিলারা।রাজবাড়ীর অষ্টধাতুর মূর্তিতে মা একাই পূজিত হন। এখানে মায়ের সাথে থাকেনা কার্তিক,গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতী।এখানে যেহেতু অষ্টধাতুর দুর্গা তাই বিসর্জন হয় না।হয় শুধুমাত্র ঘট ডুবিয়ে নিরঞ্জন দেওয়া হয়।দাসপুর ছাড়াও দুরদুরান্তের বহু মানুষ পুজোয় ভিড় জমান নাড়াজোল রাজবাড়ীর দুর্গা পুজোয়।পুজো কদিন রাজ বাড়িতেই পুজোয় মাতেন বর্তমান পিড়িরা।দাসপুরের নাড়াজোল রাজবাড়ী পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি ঐতিহাসিক স্থান।মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জড়িয়ে আছে নাড়াজোল রাজবাড়িতে।

রাজা নরেন্দ্রলাল খান ও তার পুত্র দেবেন্দ্রলাল খান প্রকৃত দেশপ্রমিক হিসাবে পরিচিত ছিলেন।ক্ষুদিরাম বসুর বাবা তৈলক্ষনাথ বসু নাড়াজোল রাজবাড়ীর প্রধান কর্মচারী ছিলেন।রাজবাড়ির যা খাজনা আদায় হতো উনি রাজাবাহাদুরকে তার হিসাব দেখাতেন বলে জানান রাজবাড়ির বর্তমান সদস্য।এমনকি এই রাজবাড়িতে বিশিষ্ট অতিথিদের আগমন ছিল।রাজবাড়ি পরিদর্শন করেছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর,বিদ্যাসাগর,কাজি নজরুল ইসলাম থেকে মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহেরু, জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী।এই রাজবাড়ির সাথে ওনাদের একটা মধূর সম্পর্ক ছিল বলে জানান রাজবাড়ির সদস্য বিদ্যুৎ খান।রাজ বাড়ির বর্তমান সদস্যদের কথায়,পুজোয় আগের মতো জৌলুস না থাকলেও সমস্ত রীতিনীতি এখনও বজায় রয়েছে।তবে আর্থিক অনটনের জেরে পুজোর এলাহি আয়োজনে অনেক কাটছাঁট করতে হয়েছে।

শুধু পুজো নই,রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রাজবাড়ীর মুল ভবন ভগ্নপ্রায়,আগাছায় ঢাকা পড়েছে।রাজবাড়ীর অদূরে রয়েছে ‘হাওয়া মহল’।তারও কিছু দুরে এক বিশাল পুকুর বা জলাশয়ের মাঝেই রয়েছে ‘জলহরি’ তথা রাজাদের আউট হাউস।বর্তমানে সেটিও আগাছা বা পানায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে।রাজবাড়ীর বর্তমান পরিস্থিতি যেমনটা থাকুক রাজাবাহাদুরদের হাতে সূচনা হওয়া দুর্গা পুজো আজও সমস্ত রীতিনীতি মেনে দেবী দুর্গাকে পুজিত করেন বর্তমান সদস্যরা।

এই বিষয়ে জয়শ্রী খান,কুমকুম খানরা বলেন,”পুজোর সব জোগাড় করি কিন্তু দূর থেকে।মায়ের বিদায় বেলায় সিঁদুর খেলায় অংশ নিই আমরা।অষ্টধাতুর মূর্তিতে মা একাই পূজিত হন।আমাদের মায়ের সাথে থাকে না কার্তিক,গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতী। তাছাড়া আমাদের অষ্টধাতুর দুর্গা তাই বিসর্জন হয় না।শুধুমাত্র ঘট ডুবিয়ে নিরঞ্জন দেওয়া হয়।বড়দের কাছে শুনেছি এই বাড়ি পরিদর্শন করেছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, কাজি নজরুল ইসলাম থেকে মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহেরু, জওহরলাল নেহেরু,ইন্দিরা গান্ধী সহ অন্যান্যরা।

অন্যদিকে বাড়ির সদস্যরা বিদ্যুৎ খান বলেন, “রাজ বাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী থেকে বিভিন্ন মনীষীদের।এই রাজবাড়ীতে বৈষ্ণব মতে পূজিত হন মা দুর্গা,তাই নেই বলি প্রথা।সেই প্রথা মেনে আজও রাজবাড়ির মহিলারা মায়ের অঞ্জলি দিতে পারেন না।নিতে পারবেন না প্রসাদ ও বেলপাতাও।তবে আর্থিক কারণে আজ আর বিলাস বহুল নর নারায়ণ সেবার আয়োজন করা হয় না।আগেকার মত জৌলুস আর নেই ফিকে হয়েছে বনেদিয়ানা।”