
মেদিনীপুর 26 সে সেপ্টেম্বর:
পশ্চিম মেদিনীপুরের নাম শুধু বিপ্লবীদের কারণে বিখ্যাত হয়নি,বিখ্যাত হয়েছে পুরানো রাজা রাজড়া ও তাদের জমিদারি প্রথা।সেইসঙ্গে তাদের জমিদারি পুজোর কারণে। এরকমই এক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পুজোতে সামিল হতো মেদিনীপুর শহরের মল্লিক চকের মল্লিক বাড়ির সদস্যরা।যদি বর্তমানে সেই দেবত্ব সম্পত্তি কতিপয় লোক লোভের কারণে দখল নিচ্ছে যার ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত হয়ে কোনক্রমে টিকিয়ে রেখেছে এই দুর্গাপুজো।

এরকমই করুন কাহিনী মেদিনীপুর শহরের মল্লিক বাড়ির দুর্গাপুজোর।এই পুজো সম্পর্কে জানতে গিয়ে শোনা যায় মেদিনীপুর শহর ও জেলার পুরানো ও পুরাতন পুজো হলো এই মল্লিক বাড়ির দুর্গাপুজো।এই দুর্গাপুজো প্রায় 300 বছরের অধিক বয়স।বর্তমান প্রজন্ম হলো 13 তম জেনারেশন। যারা এ বছরের পুজোয় শামিল হয়েছে। এই বাড়ির পুজোর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জন্মেঞ্জয় মল্লিক।এই মল্লিক বাড়ির পুজো প্রতিপদ থেকে শুরু হয় অর্থাৎ মহালয়ার পরের দিন থেকে শুরু হয়ে যায় দুর্গা পুজোর সূচনা। যদিও সেই পুরানো রীতিনীতি না থাকলেও তবে এই প্রতিপদ থেকে শুরু হওয়া পূজোর ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছে বর্তমান প্রজন্ম।সন্ধি পুজোর দিন কামান দাগা হতো যার আওয়াজে কেঁপে উঠতো অবিভক্ত মেদিনীপুর।এই আওয়াজে বাকি দুর্গাপুজোর সন্ধি পুজো হত।বাড়ির মেয়েরা নতুন শাড়ি পরিধান করে নানান রীতিনীতি মেনে ঘট ডোবাতে যেতেন। প্রতিপদ থেকে শুরু হওয়া পূজো চলত দ্বিতীয়া হয়ে দশমী পর্যন্ত ৷

সেই সময় রুপোর গয়না পরে বের হতেন মা।মূলত একচালার প্রতিমা ডাকের সাজে সাজানো হত মা মৃন্ময়ী কে।গোস্বামী মতে এখনও ফলমূল সহকারে মায়ের পুজো হয়।বর্তমান প্রজন্মের থেকে শোনা গিয়েছে,সেই সময় বেনারস থেকে পুরোহিত এনে জাঁকজমকভাবে পুজো হত।প্রতিদিন কুড়ি মণ চালের নৈবেদ্য সাজিয়ে দেওয়া হত দেবীর সামনে । পুজোর ক’দিন বসত কীর্তন,চণ্ডীপাঠ ও কৃষ্ণযাত্রার আসর,অষ্টমীর দিন হত কুমারী পুজো।সারা বছর দুর দূরান্তে থাকলেও এই পুজোর কটা দিন মল্লিক বংশধরেরা ছুটে আসত তাদের পুরানো বাড়িতে। তাছাড়াও এই পুজোয় দূর-দূরান্তের বহু রাজারা পুজোর আমন্ত্রণ পেতেন। শোনা যায় এই দুর্গাপুজোয় 9 জন পুরোহিত মিলে মল্লিক বাড়ির দুর্গাপুজো করতেন।মল্লিক বাড়িতে বলি প্রথা ছিল না।দশমীর পুজোর পর কুলদেবতার পুজো শেষ হলে কনকাঞ্জলি দেওয়ার রীতি ছিল।তবে প্রতিমা নিরঞ্জন হতো বর্ণাঢ্য ঢাক ঢোল সহকারে।

এও শোনা যায় 32 জন বেহারার কাঁধে চেপে
কংসা বতীতে প্রতিমা যেত।পালকি করে বাড়ির মহিলারা নিরঞ্জনে যেতেন।হাতি-ঘোড়া চড়ে যেতেন পুরুষরা।কেউ কেউ বলেন মল্লিকবাড়ির এই বিশাল শোভাযাত্রা দেখতে রাস্তার দু’ধারে ভিড় জমাতেন শহর ও জেলার মানুষ। তবে এখন আর তেমন জৌলুশ নেই এই বাড়ির পুজোয়। আর হাতি ঘোড়া আর আসে না এই পুজোয়,নেই কামান দাগার আওয়াজ।কিন্তু আজও প্রতিপদ থেকে পুজো হয়।আজও কাঁধে চড়ে মায়ের বিসর্জন হয় তবে বংশ ধরদের কাঁধে চেপে।অন্যদিকে দুর্গাপুজোর পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পুজো ও রাস উৎসব হয় জাঁকজমকভাবে এই পরিবারে।এখন বর্তমান বংশধরেরা বিভিন্ন জেলা রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার ফলে ভগ্ন হয়ে পড়েছে বাড়ির দশা।তবে পুজোর কটা দিনে উপস্থিত হন সমস্ত পরিবারের সদস্য।বর্তমানে দেবত্ব জায়গা দখলের এক রাশ অভিযোগ জানিয়েছে পরিবারের সদস্যরা।একদিকে বাড়ির ভগ্ন দশা অন্যদিকে এই দেবত্ব সম্পত্তি বেশ কিছু কতিপয় অসাধু মানুষ ক্রমাগত জায়গা দখলের ফলে অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত পরিবার।এর ফলে পুজোর জাঁকজমক হারিয়েছে তারা।আগামী দিনে পুজো আদেও করতে পারবেন নাকি এই আশঙ্কায় পরিবারের লোকজন।

এই বিষয়ে বর্তমান দায়িত্ব পাওয়া হিমাদ্রি শেখর কর বলেন”মল্লিক বাড়ির পুজো দুর্গা পুজো নয় রাধাকান্ত জিওর পুজো দিয়েই প্রতিষ্ঠিত।আমার ঠাকুমা সব সম্পত্তির মালিক এবং তিনি কর পদবী থাকায় পরবর্তীকালে আমরা মল্লিক বাড়ির পুজো এই করেরা করে আসছি। আমরা শুধু অন্যান্য জমিদার বাড়ির মত শুধু দুর্গাপূজা করি না আমাদের রাস, রথ, জগধাত্রী লক্ষ্মী,সরস্বতী সমস্ত পুজোয় করে আসছি।তবে আমাদের আগের মতো একই ট্র্যাডিশন মেনেই পুজো হচ্ছে,শুধু হাতি ঘোড়া আসে না বাকি সব একই রকম এবং আমরা ফলমূল বলি দিয় পশু বলি না।

তবে বর্তমানে আমরা আর্থিক কারণে সমস্যায় জর্জরিত আমাদের দেবত্ব সম্পত্তি কতিপয় মানুষ বিভিন্নভাবে দখল করে দিচ্ছে, যা আমরা বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তরে জানিয়েছি কিন্তু উদ্ধার করতে পারছি না।যার দরুন আগামী দিনে এই পুজো আর হবে কিনা তার অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।সরকারের কাছে আবেদন জানাবো যেন এই দেবত্ব সম্পত্তি বাঁচিয়ে রাখে কারণ এটা বাংলার এক সংস্কৃতি।

অন্যদিকে নাতি সুদীপ কর বলে,”কিছু ব্যবসায়ী এবং দুষ্টু মানুষ আমাদের ইনকাম করার দেবত্ব সম্পত্তি গুলোকে ছলে বলে কৌশলে দখল করে নিচ্ছে।যার সুযোগ করে দিচ্ছে এই প্রশাসনের কিছু ব্যক্তি।তাই আমরা চাই সেগুলোকে উদ্ধারে নজর দিক সরকার না হলে এই পুজো অকালেই হারিয়ে যাবে।