Durgapuja Story:টানা বৃষ্টিতেও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে জাড়া জমিদার বাড়ি!সব চলে গেলেও 226 বছর ধরে ঐতিহ্য ও পরম্পরা টিকিয়ে রেখেছে বর্তমান প্রজন্ম

Share

জাড়া 12 ই সেপ্টেম্বর:

একসময় গ্রামের মানুষকে একত্রিত করার জন্য শুরু হয়েছিল এই পুজো। পরে একাধিক বড় বড় মনীষী বিশিষ্ট ভিভিআইপিরা এসেছে এই পুজোকে সর্বাঙ্গিক সুন্দর করে তোলে।রাজা রামমোহন রায়,বিদ্যাসাগর ও মহানায়ক উত্তমকুমারের স্মৃতি বিজড়িত চন্দ্রকোনার জাড়া জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো এবারে 226 তম বর্ষে।প্লাবিত এলাকা হয়েও ঐতিহ্য ও পরম্পরা মেনে চলছে পুজোর প্রস্তুতি।

বিপ্লবী শহর পশ্চিম মেদিনীপুরের আনাচে-কানাচে বিপ্লবীদের যেমন বাড়ি ঘর রয়েছে ঠিক তেমনি একাধিক পুরনো ঐতিহ্যপূর্ণ দূর্গোপূজো রয়েছে। যে পূজো একসময় কামান দেগে,বলি প্রথা দিয়ে,জমিদার বাড়ির শাসন দ্বারা কখনো কখনো অনুষ্ঠিত হতো এই পুজো এখনো কোনক্রমে টিকিটে রেখেছে তার বর্তমান প্রজন্ম। এরকমই এক পুজোর প্রদীপ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনার এক নম্বর ব্লকের জাড়া গ্রামের জমিদার বাড়ির রায়বাবুদের দুর্গাপুজো। বর্তমান প্রজন্মের তথ্য অনুযায়ী ১১৫৫ বঙ্গাব্দে(১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দ) জাড়া জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাম গোপাল রায়।পরবর্তী সময়ে তার ছেলে রাজা রাজীবলোচন রায় বর্ধমান রাজার থেকে ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেছিলেন।তারপর থেকে জমিদারি আরও বিস্তার লাভ করে এবং তিনিই জমিদার বাড়িতে দুর্গা পুজোর সূচনা করেছিলেন।

তৎকালীন সময়ে পুজোতে বহু মনীষী আমন্ত্রিত হিসাবে আসতেন বলে জানান জমিদার বাড়ির বর্তমান সদস্যরা। কারণ সেই সময় ছিল বাংলা ছিল স্বাধীনতার এক পিঠস্থান এবং পটভূমি।এইসঙ্গে বহু মনীষীদের এবং বিপ্লবীদের আনাগোনা। পরিবার সূত্রে এও জানা যায় জমিদার রাজীবলোচন রায়ের বন্ধু ছিল রাজা রামমোহন রায়।তার যেমন যাতায়াত ছিল এই বাড়িতে তেমনি সখ্যতা ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের।জমিদার পরিবারের আমন্ত্রণে জাড়া স্কুলের স্থাপনা করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।এমনকি শোনা যায় পরবর্তীকাল মহানায়ক উত্তম কুমারের যাতায়াত ছিল এই বাড়িতে।এমনকি জাড়া জমিদার বাড়িতে মহানায়ক উত্তমকুমার তার ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবির শুটিং করেছিলেন,যা ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে একটি গানের মাধ্যমে উল্লেখ রয়েছে।সেই গানটি হল,’কি করে বললি জগা জাড়ার গোলক বৃন্দাবন,যেখানে বামুন রাজা চাষী প্রজা,চারিদিকে তার বাঁশের বন।’বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা নাকি এই গান বেঁধে ছিলেন যা ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতেও তুলে ধরা হয়।

জমিদার বাড়ির এই পুজোর বিশেষত্ব:

অন্যান্য জমিদার বাড়ির দুর্গা পুজোর পাশাপাশি এই জাড়া জমিদার বাড়ির পুজোর বিশেষত্ব ছিল একদমই একটু অন্যরকম।রুপোর পালকিতে করে গ্রামের একটি পুকুরে শোভাযাত্রা করে নবপত্রিকা স্নান হত প্রথমে। এই জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজোর পাশাপাশি পাশাপাশি কালী, বিষ্ণু দেবতা,শিব সহ একাধিক দেবদেবীর মুর্তির পুজো হতো যার মন্দির রয়েছে বর্তমানে। এই পুজোয় অংশ নিত এই জমিদার বাড়ির সকল সদস্যরা।বৈষ্ণব মতে জমিদার বাড়িতে দুর্গা পুজো হওয়ায় কোনও বলি হয়না। তিন বেলা ভোগ চড়িয়ে নিত্যসেবা করা হয়।পুজোর সময় কবি গানের আসর,যাত্রাপালা। এলাকার মানুষের খাওয়ানোর জন্য বসত নঙ্গরখানা।জমিদার বাড়িতে পুজোর দিনগুলিতে মায়ের জন্য ভোগ রান্না থেকে নাড়ু তৈরি একমাত্র অগ্রাধিকার পাই পরিবারের মহিলারই।

তবে বর্তমানে আর নেই জমিদারী রাজ বা জমিদারি প্রথা, নেই সেইসব জমিদার। তবে সেই জমিদারি পুজোর ঐতিহ্য রয়ে গেছে এই পুজোতে। যদিও এ বছর ২২৬ বছরে পদার্পণ করলই দুর্গাপুজো। বর্তমানে টানা বৃষ্টি এবং এলাকা প্লাবিত হলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে জমিদার বাড়ির বিশাল প্রাসাদ,যা এখন ভগ্নপ্রায়, আগাছায় ঢাকা।তবে তখন কারের মতো শতাধিক জমিদার বা জমিদারিনি সদস্য নেই বর্তমানে জমিদার বাড়ির ২১ টি পরিবার এখনও বসবাস করেন কিন্তু তাদের অধিকাংশই এখন কর্মসূত্রে ভিন রাজ্য বা ভিন দেশে। যে যার মত কর্মসূত্রে থাকলেও এই পুজোর বিশেষ দিনে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে সকলেই ফিরে আসেন তাদের পুরানো স্মৃতিতে।পুজোয় আগের মতো জৌলুস না থাকলেও এখনও সমস্ত রীতিনীতি মেনেই পুজোর আয়োজন হয়ে থাকে।

আগের মত পনের ষোলটা গ্রামকে খাওয়ানো হয় না তবে এলাকার কিছু মানুষের জন্য নরনারায়ন সেবা করা হয়।বিসর্জনের দিন পরিবারের সকল সদস্য মিলে বিষাদের সুরে গান গেয়ে দুর্গা প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের পুকুরে বিসর্জনের জন্য। ইতিমধ্যে এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে শুরু হয়েছে পুজোর প্রস্তুতি। চারিদিকে বাঁশের ম্যারাপ বাঁধার সঙ্গে চলছে প্রতিমা তৈরীর কাজ। তবে বর্তমান প্রজন্মের বক্তব্য বৃষ্টি একটু কমলে ভালো হতো তার সঙ্গে অর্থ সংকট রয়েছে না হলে হয়তো ভেঙে যাওয়া এই যারা জমিদার বাড়ি সাজিয়ে তুলতেন তারা।

এই বিষয়ে চঞ্চল রায় ও অভিজিৎ রায়রা বলেন,”বাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ঐতিহ্য পরম্পরা। এ বাড়ির সদস্যরা যে যেখানেই থাক তুই কটা দিন চুটিয়ে উপভোগ করেন এই বাড়িতে।শুধু এই বাড়ির নয়,তার সঙ্গে গ্রামের সমস্ত মানুষ অংশগ্রহণ করে,অংশগ্রহণ করে আদিবাসী মাহাতো,সাঁওতালের পরিবারের লোকজন।আমাদের একই মেডে দালানে পুজো হয় প্রত্যেক বছর। মূলতই কিছু হয় বৈষ্ণব মতো। হ্যালো তবে প্রথম থেকেই এই পুজোতে বিভিন্ন মনীষী বিপ্লবীরা সহ আসা যাওয়া ছিল মহানায়ক উত্তম কুমারের।তার স্মৃতি বিজড়িত এই পুজো আজও বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা।

অন্যদিকে বাড়ির যামিনী রায় নামে এক বৌমা বলেন,এই বাড়ির পুজো অত্যন্ত প্রাচীন।শাশুড়ির কাছ থেকে তার গল্প কথা শুনে এসেছি।এই পুজোতে মেয়েদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।নব পত্রিকা স্নান থেকে পুজোর বিসর্জন পর্যন্ত মেয়েরাই মূল ভূমিকা পালন করে।তবে আগের মত জৌলুস নেই কিন্তু পুজো হয় ঐতিহ্য ও পরম্পরা মেনে। তবে এ বছর টানা বৃষ্টিতও আমাদের বাড়ির পুজোতে কোন ঘাটতি থাকছে না।


Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

dnews.in