নিজস্ব প্রতিনিধি,ঝাড়গ্রাম:
প্রেম ও বিয়ের প্রলোভনে নাবালিকাদের নামানো হতো দেহ ব্যবসায়।অচিরেই ঝাড়গ্রামের বুকে তৈরি হচ্ছিল এমন একটি নারী পাচারও দেহ ব্যবসার চক্র।সন্ধান পেতেই চক্রের মূল পান্ডাদের নির্মূল করল ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশ।১৭ বছরের এক নাবালিকাকে নারী পাচার,অপহরণ,ধর্ষণ সহ একাধিক অভিযোগের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত এক মহিলা সহ ৪ জনের। অভিযোগের ১০ মাসের মধ্যে ২০ বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দিল ঝাড়গ্রাম আদালত।এই সাজা ঘোষণা করেন ঝাড়গ্রামের দ্বিতীয় অতিরিক্ত ও জেলা দায়রা আদালতের বিচারক চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়।
ঘটনাটি শুরু হয়েছিল একটি নাবালিকা অপহরণের ঘটনা থেকে।গত ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের ১৭ তারিখ ঝাড়গ্রাম থানার অন্তর্গত ১৭ বছরের এক নাবালিকার মা ঝাড়গ্রাম থানায় তার নাবালিকা মেয়ের অপহরণের অভিযোগ জানায়।সেই অভিযোগে নাবালিকার মা জানিয়েছিলেন গত ১৬ তারিখ থেকে তার মেয়ে নিখোঁজ। বহু সন্ধানের পরও কোথাও খোঁজ পায়নি মেয়ের।এই ঘটনার তদন্ত নেমে ঝাড়গ্রাম থানার পুলিশ কৌশিক সিংহ ওরফে লাদেন এবং ঝাড়খন্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভূম জেলার চাকুলিয়া থানার বাসিন্দা অজয় দাস কে গ্রেফতার করে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর অভিযোগের ১০ দিনের মাথায় আগস্ট মাসের ২৬ তারিখ ঝাড়গ্রাম রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকা থেকে নাবালিকাকে উদ্ধার করে পুলিশ। সেই নাবালিকা কে জিজ্ঞাসাবাদে পর সামনে আসে নারী পাচারের চক্রের কথা।তারপরেই ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশের পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিনহার নেতৃত্বে পুলিশ সুপার,ঝাড়গ্রাম থানার আইসি বিপ্লব কর্মকার নিয়ে গঠিত হয় সিট।নারী পাচারের মূল পান্ডাকে ধরার জন্য জোর কদমে শুরু হয় তদন্ত।
তারপর লালগড় থানা এলাকার বাসিন্দা বাবর বেগ নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।এরপর সামনে আসে ঝাড়গ্রাম শহরের বাসিন্দা পিংকি বিশাল ওরফে সোনালী বিশাল নামের এক মহিলার নাম।পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে,নারী পাচারের মূল পান্ডা এই পিংকি বিশাল।কৌশিক,অজয় এদের মত ছেলেদের মাধ্যমে নাবালিকা মেয়েদের প্রেমের জালে ফাঁসানো হতো। তারপর নানা কৌশল অবলম্বন করে নাবালিকাদের জোরপূর্বক নামানো হতো দেহ ব্যবসায়।কেউ রাজি না থাকলে তার উপর চলতো শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার।কখনো কখনো নাবালিকাদের খাওয়ানো হতো মাদক জাতীয় ওষুধ।পুরুলিয়া জেলার বলরামপুর থানা এলাকা থেকে পিংকি বিশালকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।পিংকি বিশালকে গ্রেফতারের পর গত বছর অক্টোবর মাসের ১৭ তারিখ আদালতে চার্জশিট পেশ করে।চার্জশিট পেশের তিন মাসের মাথায় পুনরায় সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট পেশ করে পুলিশ।চার্জশিটে যুক্ত করা হয় নারী পাচার, ধর্ষণ, ৪ ও ৬ নম্বর পকসো ধারা সহ একাধিক ধারা।চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখ গঠিত হয় চার্চফেম। জানুয়ারি মাসের ২৯ তারিখ থেকে শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। সেই নাবালিকার মা সহ মোট ১৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণের পর চলতি মাসের ২০ তারিখ বৃহস্পতিবার কৌশিক সিংহ ওরফে লাদেন,অজয় দাস,বাবর বেগ এবং পিংকি বিশাল কে দোষী সাব্যস্ত করে ঝাড়গ্রামের দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালত।
এই ঘটনায় সরকারি আইনজীবী কুনাল কান্তি ঘোষ বলেন,”পুলিশ অত্যন্ত দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে তদন্ত শেষ করে চার্জশিট জমা দেয়।সেই তদন্তের উপর ভিত্তি করে মোট ১৬ জনের সাক্ষী গ্রহণ করা হয়।দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর আজকে বিচারক চারজনের সাজা ঘোষণা করেছেন।কৌশিক সিংহ ওরফে লাদেন,অজয় দাস,বাবর বেগ ও পিংকি বিশাল ওরফে সোনালী বিশাল এই চার জনেরই ২০ বছরের সাজা ঘোষণা হয়েছে।যতগুলি ধারা হয়েছিল প্রতিটি ধারায় প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রত্যেকটি ধারাই সাজা ঘোষণা হয়েছে।এছাড়াও প্রত্যেককে জরিমানা করা হয়েছে।বিভিন্ন ধারায় জরিমানার টাকা দিলে সেই টাকা নাবালিকাকে দেওয়া হবে এবং নাবালিকাকে তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত”।সরকারি আইনজীবী আরও বলেন,”ঝাড়গ্রাম জেলার মধ্যে নারী পাচারের বিরুদ্ধে এটা একটি দৃষ্টান্তমূলক সাজা।এটা অত্যন্ত দ্রুততম বিচার প্রক্রিয়া হয়েছে।১০ মাসের মধ্যে কেসটা শেষ হয়ে গিয়েছে।
ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিনহা বলেন,” এফআইআর রেজিস্ট্রেশন থেকে সাজা ঘোষণা পর্যন্ত মাত্র ১০ মাসের মধ্যে আমরা বিচার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে পেরেছি।নারী পাচারের ঘটনায় এত তাড়াতাড়ি সাজা ঘোষণা আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে কোথাও তার নিদর্শন নেই।নারী পাচার বা অপহরণের ঘটনাগুলি আমরা খুবই গুরুত্বসহকারে দেখি।ভবিষ্যতে এরকম ধরনের কোন ঘটনা ঘটলে আমরা দ্রুততার সঙ্গে সমাধান করার চেষ্টা করব এবং প্রকৃত দোষীরা যাতে কোনভাবেই ছাড়া না পায় সেই বিষয়টি আমরা সুনিশ্চিত করব”।