নিজস্ব প্রতিনিধি,মেদিনীপুর :
ঘুড়ি উড়ানো একটাই নেশা। আর যখন এই অ্যান্ড্রয়েড ও ডিজিটাল যুগ ছিল না তখন ঘুড়ি নিয়ে মেতেছিল আট থেকে আশির মানুষজন।পুজোর পরেই আকাশ ছেয়ে যেত ঘুড়িতে কিন্তু বর্তমানে হোয়াটসঅ্যাপ,ইনস্টাগ্রাম,ফেসবুকে সহ সোশ্যাল মাধ্যমের যুগে হারিয়েছে সেই মেদিনীপুরের ঘুড়ি উড়ানো।যদিও একরাশ স্বপ্ন আঁকড়ে দিন পরিবর্তনের আশায় ঘুড়ি আঁকড়ে বেঁচে রয়েছে মেদিনীপুরের ব্যবসায়ীরা।
এক সময় ছিল,যখন বিশ্বকর্মা পূজার পর থেকেই ছোট কচিকাচা ও তরুন কিশোররা ঘুড়ি লাটাই হাতে বেরিয়ে পড়তো বাড়ির বাইরে।সারাদিনব্যাপী তারা ঘুড়ি উড়াতো মাঞ্জা দেওয়া সুতো দিয়ে।এই ঘুড়ি যেমন হত কাগজের তেমনি তার ভিন্ন ভিন্ন ধরণ থাকতো। থাকতো দৌরঙা,তিনরঙা,চৌরঙ্গী,মাথা কাটা,দাদুভাই,পেট কাটা এবং বড় বড় ঢঙ ঘুড়ি প্রচলিত নামে পরিচিত ঘুড়ি ও লাটাই।এর সঙ্গে কাঁচের গুড়ি এরারোড দিয়ে মাঞ্জা দেওয়ার প্রবণতা থাকতো এই মেদিনীপুরের মানুষদের।এই ঘুড়ি ওড়াই নি এমন মানুষ পাওয়া খুব কঠিন ছিল সেই সময়।পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে প্রায় ঘন ঘন মাঞ্জা দেওয়া হতো বিভিন্ন মাঠে-ঘাটে এবং নদীর ধারে। এরপর পৌষ সংক্রান্তির দুদিন জমজমাট থাকতো আকাশযুদ্ধ। রীতিমত সকাল-সকাল উঠেই ঘুড়ি লাটাই নিয়ে ছাদে উঠে যেত তৎকালীন মানুষজন।তার স্বরে লাউড স্পিকার বাজিয়ে গান,গানের সঙ্গে নাচ এবং সেই সঙ্গে অপরের ঘুড়ি যুদ্ধ লেগে যেত আকাশে।কেটে গেলেই মাইক্রোফোনে উঠত ভো কাটটা বলে।
শুধু দিনের বেলা না রাতের বেলাও ঘুড়ি উড়ানোরও প্রবণতা ছিল। রাতের বেলায় রাত্রে ছাড়া হত ফানুস এই ঘুড়ির সুতোর সঙ্গে বেঁধে আকাশে।কিন্তু সেই গুলো এখন অতীত।এখনকার বাচ্চারা আর ঘুড়ি লাটাই মজে নি, মজেছে মোবাইল ল্যাপটপ এবং গেমিংয়ে।তারা সোশ্যাল দুনিয়ায় এখন ব্যস্ত তাই ফেসবুক,ইনস্টাগ্রাম,রিলস,টুইটার টেলিগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মানুষজন।সেই চির পরিচিত ঘুড়ির জনপ্রিয়তা হারিয়েছে আস্তে আস্তে মেদিনীপুর থেকে। একদিকে যেমন ঘুড়ি ওড়ানো কমে গেছে অন্যদিকে যেটুকু ওড়ে তাও নাম মাত্র।আজ আর হাতে মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় ঘুড়ি ওড়ানো হয় না তার জায়গায় দখল নিয়েছে চিনা মাঞ্জা সুতো আর কাগজের ঘুড়ির জায়গায় দখল নিয়েছে প্লাস্টিকের ঘুড়ি। ঘুড়ি সুতোর দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। যদিও মেদিনীপুর জেলা ও শহরের ঘুড়ির দোকানদাররা অপেক্ষা করে থাকে সেই দিনের।একদিন হয়তো আবার সেই ঘুড়ি উড়ানো ধুমধামে মেতে উঠবে,মেদিনীপুরের মানুষ জন।
দীর্ঘ ২৫-৩০ বছর ধরে দোকান দেওয়া আসা দোকানিরা বলেন আগের মতন সেই পাগলামো ঘুড়ি উড়ানোর হয়তো আর নেই। এখনকারের ছেলেমেয়েরা এই কৃত্রিম সুতো লাটাই নিয়ে নামমাত্র ঘুড়ি উড়িয়ে দায়িত্ব সেরে ফেলে।এখন আর হাতে দেওয়া মাঞ্জা সুতো বিক্রি হয় না,এই সুতো সম্পূর্ণটাই তৈরি করা কোম্পানির।আমাদের প্রজন্ম হয়তো ঘুড়ি ব্যবসা করবে কিন্তু আগামী প্রজন্ম হয়তো আর করবে না।তাছাড়া বাচ্চাদের এই মোবাইলের নেশার দাপটেই কমেছে সেই চিরা চরিত এই ঘুড়ি উড়ানো। আস্তে আস্তে হারাচ্ছে এই নস্টালজিয়ার ঘুড়ি।
যদিও ঘুড়ি কিনতে আসা ক্রেতাদের বক্তব্য মোবাইলের যুগে হারিয়েছে অবশ্যই ঘুড়ি। তবে তার সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ানোর সুতোর দাম মানানসই দিয়ে বেড়ে গেছে এবং সঙ্গে পরিবেশগত পরিবর্তন হয়েছে। কারণ ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য যে প্রয়োজনীয় বাতাস লাগে তাও নেই এই সময়ে।যার ফলেই বাচ্চারা মোবাইলে আসক্ত এবং ঘুড়ি হারাচ্ছে মেদিনীপুরে।